খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

নগরীর অপরাধ প্রবণ ঘাট এলাকা

স্বঘোষিত বিএনপি’র নিয়ন্ত্রণে চলছে দখলদারী, চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট

নিজস্ব প্রতিবেদক |
০১:৪২ এ.এম | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪


৫ আগস্ট স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপি’র কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়, দলে এই মুহূর্তে যেন কোনো অনুপ্রবেশকারী না ঢোকে। নিষেধ করা হয় দলে যেনো কেউ যোগদান করতে না পারে। কিন্তু থেমে নেই কথিত অনুপ্রবেশকারীদের। তারা এখন স্বঘোষিত বিএনপি’র ব্যানারে বিএনপি বনে গেছে। যারা কখনও বিএনপি করেনি। ছিল বিগত আ’লীগ সরকারের ক্যাডার ও লাঠিয়াল বাহিনী। ঘাট এলাকার সকল অপরাধ কর্মের সঙ্গে তারা ছিল একে অপরের সহযোগী। ঘাটের পণ্য চুরি থেকে, মাদক কারবারী, কমিশন বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, দখলদারি, কিশোর গ্যাংয়ের পাতি গডফাদার সব কিছুর সঙ্গে তারা ছিল জড়িত। ফ্যাসিস্ট আ’লীগ সরকারের পতনের আগের দিনও তারা ঘাট এলাকায় অস্ত্র মহড়া থেকে গুলি বর্ষনের ঘটনা সাথে জড়িত ছিল। তারাই এখন ঘাট এলাকার স্ব-ঘোষিত বিএনপি নেতা। কেউ কেউ যুব ও ছাত্রদলের কর্মী বলে পরিচয় দিচ্ছেন। নাম ভাঙাচ্ছে দলের কিছু নেতার অনুসারী হিসেবে। এভাবে নগরীর ঘাট এলাকায় দাপোট চলছে স্বঘোষিত বিএনপি পন্থিদের । 
এক সময় নগরীর ঘাট এলাকায় খুনী এরশাদ শিকদার ও তার প্রতিপক্ষ মোসলেম উদ্দিন খান গড়ে তোলে এক অপরাধ জগত। নগরীর বড়বাজার থেকে ৪ ও ৫ নং ঘাট এলাকায় বিচরণ ও আধিপত্য ছিল খুনী এরশাদ শিকদারের। আর মোসলেম উদ্দিন খানের দখলে ছিল ৬ ও ৭নং ঘাট এলাকা। এরশাদ শিকদার আর মোসলেম যুগের অবসান হলেও ঘাট এলাকার অপরাধ বন্ধ হয়নি। নতুন নতুন কৌশল ও গডফাদারের ছত্রছায়ায় সেগুলো চলে আসছে। বিগত দিনে ঘাট কেন্দ্রিক নিজস্ব বলয় গড়ে তোলেন আ’লীগের কয়েকজন কাউন্সিলর ও প্রভাবশালী নেতা। একাধিক শ্রমিক সংগঠনের ব্যানারে চলে দখল ও চাঁদাবাজি। চলে মাদক কারবারী থেকে সব ধরনের অপরাধ।
গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আ’লীগ সরকারের পতনের পর রাতারাতি সেখানে পালাবদল হয়েছে। যে ব্যক্তি জীবনে কোনো দিন বিএনপি বা তার কোনো অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলনা এমন কিছু ব্যক্তি এখন স্বঘোষিত বিএনপি নেতা বা কর্মী ও সমর্থক সেজেছেন। অথচ ৫ আগস্টের আগে তারা ছিল আ’লীগের অনুসারী এবং আ’লীগের অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের ক্যাডার বাহিনী। 
সরেজমিনে নগরীর ঘাট এলাকায় পরিদর্শনে দেখা যায়, ৬ ও ৭নং ঘাটের জাহাজী হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নটি (রেজিঃ ১৯১৩) ৫ আগস্টের পর নিরব অভ্যুত্থান ঘটেছে। ইউনিয়নের সভাপতি মাহবুব ইসলাম শামীম ছিলেন আ’লীগ নেতা। কমিটির অন্য সদস্যরাও ছিলেন তার অনুসারী। কিন্তু তারা এখন স্বঘোষিত বিএনপি নেতা হয়ে গেছেন। আর মাহবুব ইসলাম শামীম এলাকা ছেড়েছেন। ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান, ক্যাশিয়ার খলিলুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল জলিল, সহ-সভাপতি ওয়াহিদুল, প্রচার সম্পাদক ফারুক এবং যুগ্ম-সম্পাদক খায়রুল ইসলাম এক হয়ে গেছেন। যারা প্রত্যেকেই আ’লীগ ও শ্রমিক লীগের সঙ্গে জড়িত থেকে এলাকায় আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন অতীতে। বর্তমানে তারা সকলেই বিএনপি হেয়ে গেছেন। অভিযোগ আছে, উলে­খিত ব্যক্তিদের কেউ কেউ গত ৪ আগস্ট রাতে গুলি ছুঁড়ে ঘাট এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি এবং বিএনপি কর্মীদের ধাওয়া করে। তারাই এখন স্বঘোষিত বিএনপি।
হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের একাধিক সাধারণ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত ৫ আগস্টের পর ইউনিয়নের প্রধান কার্যালয়টির সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে যায় এবং পার্শ^বর্তী ২১নং ওয়ার্ডের একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে টাঙিয়ে দিয়েছে অন্য একটি শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। তাদের মতে ২১নং ওয়ার্ডের ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের (রেজিঃ ৬২২)-এর সদস্য পরিচয়দানকারী মনির, রবি, বাবুল, তালেব, গদা কামালসহ তাদের লোকজন ওই সাইনবোর্ডটি খুলে নিয়ে যায়। নগরীর ১৪ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের মূল কার্যালয়ের মুখে কালো কালি দিয়ে ইউনিয়নের নাম মুছে দেওয়া হয়েছে। ভিতরে দেখা যায়, উপরে টাঙ্গানো হয়েছে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবি। অবশ্য ৫ আগস্টের আগে সেখানে ছিল শেখ মুজিব ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি।
শ্রমিকদের অভিযোগ ইউনিয়নের নামে এখানে একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। জাহাজ থেকে সরকারি সার, গম ও অন্য মালামাল আনলোড করার জন্য আগে ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দর কষাকষি হয় সংশ্লিষ্ট শিকাদারের। এরপর পর শ্রমিকদের কাজে লাগায় নেতৃবৃন্দ। সেখান থেকে একটি নির্দিষ্ট টাকা আদায় হয় ইউনিয়নের নামে। যার অংকটা অনেক বেশি। প্রায় ১২শ’ উপরে শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য। নেতৃবৃন্দের ইচ্ছায়-অনিচ্ছা সব কিছু মেনে নিতে হয় শ্রমিকদের। শ্রমিকদের দাবি বর্তমানে ইউনিয়নটি চলে ক্যাশিয়ার খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে। সভাপতি এলাকা ছাড়া। আর সাধারণ সম্পাদক আছেন নামকাওয়াস্তে। সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণ করছেন ইউনিয়নের ক্যাশিয়ার খলিলুর রহমান। শ্রমিকদের দাবি খলিলুর রহমান নিজে ক্যাশিয়ার, তার ভাই আব্দুল জলিল সাংগঠনিক সম্পাদক। আর যুগ্ম-সম্পাদক খায়রুল ও প্রচার সম্পাদক ফারুখও তাদের আত্মীয়। যে কারণে তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ইউনিয়ন।
এ ব্যাপারে খলিলুর রহমান বলেন, আমরা ইউনিয়নের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত কমিটি। নিজ পরিবারের সদস্যদের থাকা প্রসঙ্গে বলেন, সাধারণ শ্রমিকরা তাদের নির্বাচিত করেছে। জনপ্রিয় থাকায় তারা নির্বাচিত হয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের সাধারণ সদস্যরা নির্বাচিত করেছেন। সেখানে তার কিছুই করার নেই। 
তিনি বলেন, আমরা সরকারি মালামাল লোড-আনলোড করি। যখন যে সরকার থাকে, আমরা সেই সরকারের কাজ করি। এখানে সব দলের সমর্থকরা রয়েছে। জোর করে দখল নেওয়া এবং বিএনপি’র সমর্থক হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, অভিযোগটি ঠিক না। এখানে কাউকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি, বা চাপ দেওয়া হয়নি। সকলের মতামতের ভিত্তিতে ইউনিয়ন চলছে। জোর জবরদস্তির কোনা বিষয় না। সকল সদস্য যা চাচ্ছেন, তাই করা হচ্ছে।
সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল জলিল বলেন, আমাদের করার কি আছে, বিভিন্ন সময় সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর নব্য আ’লীগ, নব্য বিএনপি’র আগমন ঘটে। এবারও তাই হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের ইউনিয়নটি সব সময় নির্বাচন হয়। বিনাভোটে পরিচালিত হয় না। নির্বাচনে যারা পাশ করেন, তারাই নেতৃত্ব দেন। তবে ইউনিয়নের সাইনবোর্ড অন্য একটি শ্রমিক সংগঠনের সদস্যরা খুলে নেওয়া এবং ইউনিয়নের নাম কালি দিয়ে মুছে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো নেতা সদুত্তোর দিতে পারেন নি।
এলাকাবাসী জানায়, ৪ ৫, ৬ ও ৭নং ঘাট এলাকাটিতে রয়েছে একাধিক বস্তি। বাংলাদেশ রেলওয়ের জমিতে গড়ে ওঠা এসব বস্তিতে অনেকে স্থায় স্থাপনা গড়ে তুলেছে। যেখানে নগরীর বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। কেএমপি’র মাদক বিরোধী অভিযানসহ একাধিক অভিযানে গ্রেফতার ও মালামাল উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বাংলাদেশে বেতার খুলনা কেন্দ্রে যে লুটপাট হয়। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যরা সেখান থেকে বেশ কিছু মালামাল উদ্ধার এবং দুইজনকে আটক করে থানায় সোপর্দ করে। তা ছাড়া বস্তিকে কেন্দ্র করে মাদক কারবারী এবং বিশাল চোর সিন্ডিকেটের চক্র রয়েছে। যা কেএমপি’র একাধিক কর্মকর্তা স্বিকার করেছেন। যারা বিগত দিনে আ’লীগের স্থানীয় কাউন্সিলর ও নেতাদের সঙ্গে থেকে বিরোধীদল দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে তারা স্বঘোষিত বিএনপি বনে গেছে। তারাই এখন এলাকায় দখলবাজিসহ নানা অপকর্মে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এখন তারা বিএনপি’র বিভিন্ন নেতাদের নাম ভাঙিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করে যাচ্ছে।
স্থানীয় এক বিএনপি নেতা বলেন, ৫ আগস্টের পর দলের কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত অন্য কোনো দলের নেতা বা ব্যক্তিকে দলে যোগদান করানো যাবে না। কেন না সুযোগ সন্ধানীরা দলে প্রবেশ করে অপকর্ম করে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে। তবে কয়েকজন নেতার প্রচ্ছন্ন ইশারায় এসব সুযোগ সন্ধানীরা এখন স্বঘোষিত বিএনপি নেতা হয়ে গেছে। কেননা এখানে নগদ অর্থের একটি বিষয় থাকায় কোনো নেতা চুপ হয়ে গেছেন।
জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেবে : খুলনা মহানগর বিএনপি’র আহবায়ক এড. শফিকুল আলম মনা বলেছেন, অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, দলের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে শুধু সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেছেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমান। তিনি বলেন, বিগত ১৬ বছরে নেতা-কর্মীর আত্মত্যাগ, আগস্টে হাজারো ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ কিছু ব্যক্তির অপকর্মের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে না।
গতকাল (শনিবার) বেলা ১১টায় কেডি ঘোষ রোডস্থ বিএনপি কার্যালয়ে মহানগর বিএনপি’র বিশেষ জরুরি সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আ’লীগ সরকারের পতনের পর একটি মহল নৈরাজ্য ও সহিংসতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। যে কোনো মূল্যে স¤প্রীতি রক্ষা, লুটপাট, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব বন্ধসহ শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। মহানগর বিএনপি’র সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের মধ্যে পদধারী নেতা নেই। বেশির ভাগই দল থেকে পদত্যাগী, হাইব্রিড এবং দলে অনুপ্রবেশকারী। যারা দলের দুর্দিনে পাশে ছিল না, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারাই রাতারাতি দলের নাম ভাঙিয়ে অপকর্মে জড়িয়ে বিএনপি’র ভাবমূর্তি-সুনাম ক্ষুণœ করছে। এসব ব্যাপারে দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে।

্রিন্ট

আরও সংবদ